"রাম নাই যাতে এমন সে ধন/পরিত্যাগ করা ভালো নাই প্রয়োজন" – উক্তির বিশ্লেষণ
"রাম নাই যাতে এমন সে ধন/পরিত্যাগ করা ভালো নাই প্রয়োজন" – উক্তির বিশ্লেষণ
ভূমিকা
উক্তিটি কৃত্তিবাসী রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ড থেকে নেওয়া হয়েছে। এটি সীতা দেবীর একটি গুরুত্বপূর্ণ উক্তি, যেখানে তিনি রামের প্রতি তার একনিষ্ঠ ভালোবাসা, সতীত্ব এবং আত্মমর্যাদার পরিচয় দিয়েছেন। উক্তিটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ কারণ এটি শুধু সীতা-রামের দাম্পত্য প্রেমের পরিচয়ই বহন করে না, বরং নারীর আত্মসম্মান, সতীত্বের মহিমা এবং সত্য ও ধর্মের প্রতি অটল থাকার শক্তির প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হয়।
উক্তির অর্থ ও ব্যাখ্যা
সীতা বলেন:
"রাম নাই যাতে এমন সে ধন,
পরিত্যাগ করা ভালো, নাই প্রয়োজন।"
এখানে সীতা "ধন" বলতে কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা বুঝতে হলে প্রসঙ্গটি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
১. 'ধন' বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
"ধন" শব্দটি সাধারণত সম্পদ, ঐশ্বর্য বা মূল্যবান বস্তু বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। তবে এখানে ‘ধন’ বলতে সীতা বিশেষ কোনো বস্তুগত সম্পদের কথা বলেননি। বরং তিনি বোঝাতে চেয়েছেন—
- রাবণের রাজসিংহাসন ও সম্পদ: রাবণ সীতাকে তার স্ত্রী করার জন্য প্রলোভন দেখিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সীতা যদি তাকে গ্রহণ করেন, তবে তিনি রাবণের সমস্ত রাজত্বের অধিষ্ঠাত্রী হবেন।
- ঐশ্বর্য ও বিলাসিতা: রাবণ সীতাকে লঙ্কার রানী হওয়ার সুযোগ, সোনার প্রাসাদে থাকার সুখ, অগণিত দাস-দাসী ও ভোগবিলাসের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
- সামাজিক নিরাপত্তা ও সম্মান: রাবণ বলেছিলেন, রাম যদি যুদ্ধ করে পরাজিত হন বা নিহত হন, তবে সীতা বিধবা হবেন। সে ক্ষেত্রে তিনি যেন একা না থাকেন এবং রাবণের প্রস্তাব গ্রহণ করেন।
২. 'পরিত্যাগ করা ভালো' – কেন এই প্রত্যাখ্যান?
সীতা স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন যে, যে কোনো সম্পদ বা সম্মান, যেখানে রাম নেই, তা তার জন্য অপ্রয়োজনীয়। কারণ তার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো রামের ভালোবাসা ও তার সতীত্ব। তার দৃষ্টিতে—
- রামের প্রতি একনিষ্ঠতা: রামই তার একমাত্র স্বামী, এবং তার প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্য প্রশ্নাতীত। অন্য কারও সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা তার কাছে অকল্পনীয়।
- ধর্ম ও সতীত্ব রক্ষা: সীতা ধর্মের পথ অনুসরণ করেন। তার মতে, একজন নারীর জন্য সতীত্ব রক্ষা করা এবং স্বামীর প্রতি একনিষ্ঠ থাকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
- প্রলোভনের বিরুদ্ধে দৃঢ়তা: রাবণ যত বড় রাজা হোন না কেন, তার প্রস্তাব সীতার কাছে মূল্যহীন। তিনি জানতেন, এই বিলাসিতা ও সম্মান তাঁর সত্যিকারের সুখ এনে দিতে পারবে না।
উক্তিটির প্রসঙ্গ ও প্রাসঙ্গিকতা
এই উক্তিটি লঙ্কাকাণ্ডের সেই মুহূর্তে বলা হয়, যখন সীতা রাবণের বন্দীশালায় অবস্থান করছিলেন এবং রাবণ তাকে বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছিল।
১. সীতার বন্দিত্ব ও রাবণের প্রলোভন
- রাবণ বহুবার সীতাকে বলেছিলেন যে, রাম দুর্বল এবং তিনি কখনোই লঙ্কায় এসে সীতাকে উদ্ধার করতে পারবেন না।
- রাবণ তাকে রাজরানীর মর্যাদা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, রামের কথা ভুলে গিয়ে তিনি যেন লঙ্কার সম্রাজ্ঞী হন।
- তিনি হুমকিও দিয়েছিলেন যে, সীতা যদি তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, তবে তাকে হত্যা করা হবে।
২. সীতার দৃঢ় উত্তর ও আত্মমর্যাদা
এই পরিস্থিতিতে সীতা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে রাবণের সমস্ত প্রলোভন প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন—
- যে সম্পদের মধ্যে রাম নেই, তা তার কাছে মূল্যহীন।
- তিনি স্বেচ্ছায় মৃত্যু বরণ করবেন, তবু রামের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না।
- তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, রাম তাকে উদ্ধার করবেন এবং ধর্মের জয় হবে।
সীতার চরিত্রের প্রতিফলন
এই উক্তিটির মাধ্যমে কৃত্তিবাসী রামায়ণে সীতার যে চরিত্রচিত্র পাওয়া যায়, তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
১. সতীত্ব ও একনিষ্ঠতার প্রতীক
সীতা কখনো রাবণের প্রলোভনে পড়েননি এবং রামের প্রতি অটল ছিলেন। মধ্যযুগীয় সমাজব্যবস্থায় নারীদের সতীত্ব ও একনিষ্ঠতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এবং সীতা এই গুণের সর্বোত্তম উদাহরণ।
২. আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারী
তিনি কোনো অবস্থাতেই নিজের আত্মমর্যাদা হারাতে চাননি। নারী হিসেবে তিনি আত্মসম্মান বজায় রেখে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছেন।
৩. ধৈর্য ও সংগ্রামের প্রতীক
যদিও তিনি বন্দী ছিলেন, তবু মানসিকভাবে কখনোই দুর্বল হননি। তিনি বিশ্বাস রেখেছিলেন যে, সত্যের জয় হবে এবং রাম তাকে মুক্ত করবেন।
উক্তিটির সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতা
সীতার এই উক্তি আজও নারীসমাজের জন্য শিক্ষণীয়।
১. আত্মমর্যাদা বজায় রাখা
সীতার মতোই নারীদের আত্মমর্যাদা বজায় রেখে জীবনযাপন করা উচিত। অর্থ, বিলাসিতা বা সামাজিক মর্যাদার বিনিময়ে আত্মসমর্পণ করা উচিত নয়।
২. সত্য ও ন্যায়ের প্রতি অবিচল থাকা
বর্তমান সমাজেও অনেক সময় মানুষকে অসৎ পথে চালিত করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সীতার জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে সত্য ও ধর্মের পথে অবিচল থাকতে হবে।
৩. ভালোবাসার প্রতি একনিষ্ঠ থাকা
সীতার মতো ভালোবাসায় একনিষ্ঠতা ও বিশ্বাস থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বার্থপর বা প্রতারণাপূর্ণ সম্পর্ক পরিত্যাগ করাই উত্তম, যদি সেখানে সত্যিকারের ভালোবাসা না থাকে।
উপসংহার
"রাম নাই যাতে এমন সে ধন,
পরিত্যাগ করা ভালো, নাই প্রয়োজন।"
এই উক্তিটি কেবল সীতার একনিষ্ঠতা ও সতীত্বের প্রতীক নয়, এটি নারীর আত্মমর্যাদা, সত্যের প্রতি অবিচলতা এবং প্রেমের বিশুদ্ধতার প্রতীক। সীতা এখানে দেখিয়েছেন যে, প্রকৃত ভালোবাসা ও আত্মসম্মান পৃথিবীর সব ধনসম্পদের চেয়েও মূল্যবান।
কৃত্তিবাসী রামায়ণে এই উক্তির মাধ্যমে কেবল সীতার মহিমাই ফুটে ওঠেনি, বরং এটি মানবসমাজের জন্য এক চিরন্তন বার্তা হয়ে রয়ে গেছে—যেখানে ভালোবাসা, আত্মমর্যাদা ও সত্যের গুরুত্ব সবকিছুর ঊর্ধ্বে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন